লেখক হওয়া কি খুব সোজা? হাতে কলম আর টেবিলে সাদা কাগজ থাকলেই কি লেখা ঝরতে থাকে তরতর করে?
কিংবা ধরুন অনুবাদক হওয়া? মনিটরের একপাশে পিডিএফ, আরেকপাশে ওয়ার্ড ওপেন করে টাইপ করতে থাকলেই কি হয়ে যায় অনুবাদ?
অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো বলতে হচ্ছে: না হয় না। শুধু কলম-খাতা কিংবা ওয়ার্ড ওপেন করলেই লেখা বা অনুবাদ হয়ে যায় না। অন্য আর দশটা দক্ষতার মতো লেখালেখি/অনুবাদ একটি বিশেষ দক্ষতা। একে শিখতে হয়। কলাকৌশলগুলো জানতে হয়। তারপর চর্চা করতে হয় নিয়মিত। তবেই কেউ হয়ে ওঠেন নামজাদা লেখক কীবা অনুবাদক।
কীভাবে জানবেন লেখালেখির সেসব হাঁড়ির খবর? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আজ তেমনই কিছু বারুদ শেয়ার করব আপনাদের সঙ্গে। যদি আপনার মাঝে শলাকা থাকে, তা হলে জ্বলে উঠবেনই—ইন শা আল্লাহ।
▒ বারুদ ১: “মার্জিনে মন্তব্য”র, সৈয়দ শামসুল হক, অন্যপ্রকাশ
আমার স্বল্প লেখক-জীবনে যেকয়টা বই পড়ে মারাত্মকভাবে উপকার পেয়েছি তার মধ্যে এটা সবার আগে। সচেতনভাবে লেখালেখি কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই বই পড়ে।
সৈয়দ শামসুল হকের মতো সব্যসাচী লেখক বাংলাদেশে বিরল। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি হাত চালাননি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন প্রতিভার ছাপ। এই যে ছাপ রেখে যাওয়া, এটা কোনোভাবেই খেয়ালি মনের কর্ম ছিল না। তিনি ভাবতে ভাবতে লিখতেন, লিখতে লিখতে ভাবতেন। লেখালেখি সম্পর্কে তার এই ভাবনাচিন্তাগুলো এক মলাটে লিপিবদ্ধ করেছেন এ বইতে।
প্রতিটি লেখকই পাঠক, তবে আর দশটা সাধারণ পাঠকের মতো হলে তার চলবে কেন? তিনি যেকোনো লেখা পড়বেন মনোযোগী শিশুর মতো। খেয়াল করলে দেখবেন, ১/২ বছরের বাচ্চারা কী গহন মনে বড়দের—বিশেষ করে তারা বাব-মা’র—প্রতিটা কাজ হলফ করে দেখে। এরপর ঠিক বাবা-মা’র মতো না পারলেও অনুরূপ বা কাছাকাছি ঢঙে তা করার চেষ্টা করে।
একজন সুলেখক/সু-অনুবাদকের পড়ার চোখ হতে হয় ঠিক এমন। সেটা কীভাবে করতে হবে, কীভাবে ভালো লেখা পড়তে হবে, বাক্য-শব্দ নিয়ে ভাবতে হবে তার খুঁটিনাটি কতসব জিনিস যে এ বইতে আছে, না পড়লে বোঝা যাবে না। এমনকি খারাপ লেখা পড়েও যে শেখা যায় তারও উপায় বলা আছে এখানে।
কেউ নিয়মিত লিখতে চাইবেন, বা অনুবাদ করতে চাইবেন, অথচ এ বইটির অন্তত গদ্য লেখার কারুকার্য অংশটি পড়বেন না কখনো—সংলাপের ঢঙে বলতে হলে বলব, “এ হতে পারে না!”
▒ বারুদ ২: “এসো কলম মেরামত করি”, আবু তাহের মিছবাহ, দারুল কলম
আমার কেন যেন মনে হয়, সাহিত্য বলতে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, ইসলামি সাহিত্য বলতে আমরা হয়তো বুঝি ইসলাম নিয়ে যেকোনো লেখালেখি। মানে বাংলা ভাষায় আমরা কিছু একটা লিখলাম, বা অনুবাদ করলাম, তাতে বাংলা ভাষার রূপবৈচিত্র, অলংকার, সৌন্দর্য থাকুক কি না থাকুক, যেহেতু বাংলায় ইসলাম নিয়ে কিছু একটা লেখা হয়েছে, কাজেই এটা ইসলামি সাহিত্য হয়ে গেছে। এই ধারণা যে কী পরিমাণ ভুল তা আবু তাহের মিছবাহর এ বইটি না পড়লে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমাদের অনেকেই ভাস্কর্য বা মাটির তৈরি তৈজসপত্র গড়তে বা বানাতে দেখে থাকবেন। সামনসামনি না হলেও টিভি-ইন্টারনেটের কল্যাণে দেখা হয়ে থাকার কথা। কী পরিমাণ অভিনিবেশ আর যত্নের সঙ্গে এক একজন মৃৎশিল্পী যে এসব ভাঙাগড়ার কাজ করেন, তা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়ার মতন। এখন সেই একই কাজ যদি কাউকে বাংলা ভাষায় লিখতে গিয়ে করতে দেখেন, কী মনে হবে তাকে? উন্মাদ? অতি খুঁতখুঁতে?
নাহ। তাহারেই আমি কইব ভাষাশিল্পী। আবু তাহের মিছবাহ আক্ষরিক অর্থেই একজন ভাষাশিল্পী।
কোন শব্দের সঙ্গে কোন শব্দ যায়, কোন শব্দ যায় না, কোন শব্দ কার শানে খাটে, কার শানে খাটে না, শব্দের ইতিবাচকতা, নেতিবাচকতা—নবিশ লেখক/অনুবাদকদের মনে যা কখনো উদয় হওয়ার দাবি রাখে না সাধারণত, এ অঙ্গনের বাইরের কারও কাছে যা মনে হতে পারে পাগলামি—সেসব বিষয় নিয়েই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন বর্ষীয়ান এই ‘আলিম!
জি, ঠিকই পড়েছেন। তিনি একজন ‘আলিম। এবং অতি উঁচুমানের ‘আলিম। একই সাথে ভাষাশিল্পী। ‘হুজুর’দের লেখালেখি শুনলেই যে এক শ্রেণির মানুষের হলদু দাঁতগুলো কেলিয়ে ওঠে, তাদের চোখ সত্যিকার অর্থেই তিনি কপালে ওঠানোর ক্ষমতা রাখেন। মাদরাসার উঠোনে তিনি ‘আদিব হুজুর’ বা ‘সাহিত্য গুরু’ নামে পরিচিত।
শুধু শব্দই নয়, একটা লেখার প্রতিটা বাক্য ধরে ধরে কীভাবে তার সুর-সংগতি বহাল রাখতে হয়, প্রয়োজনে কেটে-ছিড়ে নতুন করে সাজাতে হয় সেই ‘অপারেশন’ দেওয়া আছে উদাহরণসহ।
আমাদের লেখালেখির অঙ্গনে এক শ্রেণির লেখক/অনুবাদক আছেন ফরমায়েশি লেখক/অনুবাদক। শুধু কাজ পেলে লেখেন, না হলে কলম ছুঁয়েও দেখেন না। অথচ মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ রোজ নিয়ম করে দিনলিপি লেখার তাগিদ দিয়েছেন। সহজাত প্রতিভা না নিয়ে জন্মানো কেউ যদি নিজেকে সাহিত্যের মঞ্চে তুলে আনতে চান, তা হলে প্রতিদিন লেখার কোনো বিকল্প নেই। এমনসব ইত্যকার নানা কৌশলে পূর্ণ এই বইটি না পড়ে কারও লেখক/অনুবাদক হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনুচিত বলে মনে করি।
▒ বারুদ ৩: “সাহিত্যের ক্লাস”, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, মাকতাবাতুল আখতার
শেখার যে কোনো শেষ নেই, সেই প্রবচনের সার্থক উদাহরণ এ বইটি।
লেখালেখি বিষয়ক বই কুড়োচ্ছি সেই ২০১৩ সাল থেকে। বাংলা ভাষায় এ-সংক্রান্ত যত বই আছে, সম্ভবত তার বেশিরভাগই ২০১৭ সালের মধ্যে পড়া হয়ে গিয়েছিল আমার। লেখালেখির কৌশল নিয়ে মৌলিক বা অভিনব যা কিছু আমি অন্যান্য বইতে পেয়েছি, তা ঘুরেফিরে উপরের প্রথম দুটো বইয়ের কথারই ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন। কিন্তু এই ২০১৮ সালে এসে যাইনুল আবিদীনের এ বইটিতে সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস—অলংকার—একদমই নতুন করে জানলাম যেন। ঠিক জানলাম বললে ভুল হবে; আগেও জানতাম, কিন্তু জিনিসটা যে আসলে কী, কীভাবে এর প্রয়োগ—তা উনার আগে কারও লেখায় এত প্রখরভাবে দেখিয়ে দেয়নি কেউ। অথচ, সাহিত্যকর্মে অলংকার খুবই খুবই জরুরি জিনিস। এই অলংকারই একটি অসামান্য কর্মকে আলাদা করে গড়পড়তা কাজ থেকে। এই অলংকারের জোরেই কুরআন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। অথচ, সেই কুরআনের অনুসারীদের লেখনীতে তা সুন্দরবনের বাঘ দেখার মতো বিরল।
এ বইয়ের আরেকটি মূল্যবান আলোচনা: অনুবাদ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ অনুবাদকর্মই যে ‘বাংলা অক্ষরে লিখিত মাত্র’ সেই হাহাকার ফুটে উঠেছে যাইনুল আবিদীনের লেখায়। কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি সেই দৈন্য দশা কাটিয়ে উঠতে। যদি পারতাম, যারা প্রথমবারের মতো অনুবাদকর্ম শুরু করতে চান, তাদের কাজ শুরুর আগে আমি এ বইটা (এবং এর পরের বইটা) অবশ্যই পড়িয়ে নিতাম। এবং এ বইটা পড়ার আগে তার জন্য অনুবাদকর্মে হাত দেওয়াকে ‘হারাম’ ঘোষণা করতাম। আপনি যদি স্রেফ ফরমায়েশি অনুবাদক হোন, যদি শুধু দুটো টাকার জন্য অনুবাদকর্ম করেন তা হলে এ বই না পড়লেও চলবে। কিন্তু অনুবাদ যদি হয় আপনার শিরা-উপশিরা, তা হলে আমার মনে হয় এ বই ছাড়া আপনার অনুবাদ বাঁচবে না।
▒ বারুদ ৪: Literary Translation: A Practical Guide, Clifford E. Landers, Multilingual Matters
অনুবাদ করা নিয়ে কোনো বই যদি ‘পাঠ্যবই’ করতে হয়, তা হলে এটা সেরকম এক বই। এ বইটিও আমি খুব বেশিদিন আগে পড়িনি। তবে না পড়ে থাকলেও বইটির বেশিরভাগ নির্দেশনা আগে থেকেই অনুসরণ করতাম অনুবাদের বেলায়। শব্দে শব্দে অনুবাদ যে আসলে একটি কুসংস্কার, ওভাবে যে আদৌ অনুবাদকর্ম সুসম্পাদিত হয় না, যাইনুল আবিদীনের ভাষায় স্রেফ ‘বাংলা অক্ষরে লিখিত হয় মাত্র’, তার পক্ষে এ বইয়ের কথাগুলো আপ্তবাক্য।
বইটি আসলেই একটি প্র্যাকটিকাল গাইড। অনুবাদ করতে গিয়ে মনের ভেতর যত সংশয়, প্রশ্ন আসতে পারে তার কোনোটিই বাদ যায়নি। আগের বইয়ের বেলায় শেষের কথাগুলো এ বইয়ের বেলাতেও প্রযোজ্য।
▒ এখন জ্বলে উঠবেন কীভাবে?
শুধু খেলা দেখে কি খেলা রপ্ত করা যায়? না, যায় না। সেজন্য মাঠে নেমে খেলতে হয়। এ বইগুলো আপনাকে লেখালেখি-অনুবাদ সম্পর্কে অভিনব সব চিন্তা আর কৌশলের কথা শেখাবে। কিন্তু তা মকশো না করলে, নিয়মিত না লিখলে, অনুবাদ না করলে তা দক্ষতা হিসেবে শেকড় হয়ে মজবুত হবে না। আপনার প্রতিটি লেখা ছাপার হরফে আসতে হবে তার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিটি লেখা ফেইসবুক বা অনলাইনে আসতে হবে তারও কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের মনের আনন্দে, নিজের লেখার উন্নতির জন্য, অনুবাদের ভাষার মাধুর্য বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে কাজ করুন। ছ মাস আগে যেভাবে লিখতেন, আজও যদি সেখানেই পড়ে থাকেন, তা হলে বুঝে নেবেন আপনার কোনো উন্নতি হয়নি। মন থেকে যদি উন্নতির টান না পান, যদি শুধু অর্থের কারণে লিখে যান, তা হলে একাজটি হয়তো আপনার জন্য নয়। যদি একদিন কিছু না লিখলে মন আনচান করে, যদি প্রতিদিন একই শব্দের পুনরাবৃত্তি আপনার মনকে বেচান করে, তা হলে বুঝবেন আপনার মাঝে শলাকা আছে। উপরে দেওয়া বারুদে ঘষে এখন শুধু জ্বলে ওঠার অপেক্ষা...
পুনশ্চ: লেখালেখিটাকে কি হঠাৎ করে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে? সত্যি কথা বলতে, সৃজনশীল কোনো কাজই সহজ নয়। ভাতের মাড় গালা দেখতে যত সহজই মনে হোক, নিজে করতে গেলে বুঝবেন কত ধানে কত চাল। সেকালের রবীন্দ্রনাথ কিংবা একালের হুমায়ূন—কেউই হাসতে-খেলতে লেখক হয়ে যাননি। কিংবা অনুবাদ সাহিত্যে একজন অনীশ দাস অপু বা কবীর চৌধুরী বা শওকত হাসানেরা স্রেফ ইংরেজিটা ভালো জানার কারণে খ্যাতনামা অনুবাদক হয়ে যাননি। এদের প্রত্যেকের জীবনটাকে খতিয়ে দেখুন: অনেক অনেক অধ্যবসায় (শব্দটা যতই আপনাকে স্কুলের রচনার কথা মনে করিয়ে দিক, বাস্তব দুনিয়ায় এর বিকল্প নাই), চর্চা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাধা ডিঙিয়ে একেকজন জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। দীনের চেতনায়, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমাদের মধ্যে যদি অনুরূপ আত্ম-নিবেদন, পরিশ্রম আর জানাশেখার মানসিকতা না থাকে, তা হলে সাহিত্যের সবকিছু দুষ্টদের দখলে চলে গেল—এমন আক্ষেপ কেবল ভার্চুয়াল মনস্তাপ আর অন্যের সমালোচনা ছাড়া ভালো কিছু দেবে না।
মাসুদ শরীফ
উপ-সম্পাদক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
কিংবা ধরুন অনুবাদক হওয়া? মনিটরের একপাশে পিডিএফ, আরেকপাশে ওয়ার্ড ওপেন করে টাইপ করতে থাকলেই কি হয়ে যায় অনুবাদ?
অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো বলতে হচ্ছে: না হয় না। শুধু কলম-খাতা কিংবা ওয়ার্ড ওপেন করলেই লেখা বা অনুবাদ হয়ে যায় না। অন্য আর দশটা দক্ষতার মতো লেখালেখি/অনুবাদ একটি বিশেষ দক্ষতা। একে শিখতে হয়। কলাকৌশলগুলো জানতে হয়। তারপর চর্চা করতে হয় নিয়মিত। তবেই কেউ হয়ে ওঠেন নামজাদা লেখক কীবা অনুবাদক।
কীভাবে জানবেন লেখালেখির সেসব হাঁড়ির খবর? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আজ তেমনই কিছু বারুদ শেয়ার করব আপনাদের সঙ্গে। যদি আপনার মাঝে শলাকা থাকে, তা হলে জ্বলে উঠবেনই—ইন শা আল্লাহ।
▒ বারুদ ১: “মার্জিনে মন্তব্য”র, সৈয়দ শামসুল হক, অন্যপ্রকাশ
আমার স্বল্প লেখক-জীবনে যেকয়টা বই পড়ে মারাত্মকভাবে উপকার পেয়েছি তার মধ্যে এটা সবার আগে। সচেতনভাবে লেখালেখি কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই বই পড়ে।
সৈয়দ শামসুল হকের মতো সব্যসাচী লেখক বাংলাদেশে বিরল। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি হাত চালাননি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন প্রতিভার ছাপ। এই যে ছাপ রেখে যাওয়া, এটা কোনোভাবেই খেয়ালি মনের কর্ম ছিল না। তিনি ভাবতে ভাবতে লিখতেন, লিখতে লিখতে ভাবতেন। লেখালেখি সম্পর্কে তার এই ভাবনাচিন্তাগুলো এক মলাটে লিপিবদ্ধ করেছেন এ বইতে।
প্রতিটি লেখকই পাঠক, তবে আর দশটা সাধারণ পাঠকের মতো হলে তার চলবে কেন? তিনি যেকোনো লেখা পড়বেন মনোযোগী শিশুর মতো। খেয়াল করলে দেখবেন, ১/২ বছরের বাচ্চারা কী গহন মনে বড়দের—বিশেষ করে তারা বাব-মা’র—প্রতিটা কাজ হলফ করে দেখে। এরপর ঠিক বাবা-মা’র মতো না পারলেও অনুরূপ বা কাছাকাছি ঢঙে তা করার চেষ্টা করে।
একজন সুলেখক/সু-অনুবাদকের পড়ার চোখ হতে হয় ঠিক এমন। সেটা কীভাবে করতে হবে, কীভাবে ভালো লেখা পড়তে হবে, বাক্য-শব্দ নিয়ে ভাবতে হবে তার খুঁটিনাটি কতসব জিনিস যে এ বইতে আছে, না পড়লে বোঝা যাবে না। এমনকি খারাপ লেখা পড়েও যে শেখা যায় তারও উপায় বলা আছে এখানে।
কেউ নিয়মিত লিখতে চাইবেন, বা অনুবাদ করতে চাইবেন, অথচ এ বইটির অন্তত গদ্য লেখার কারুকার্য অংশটি পড়বেন না কখনো—সংলাপের ঢঙে বলতে হলে বলব, “এ হতে পারে না!”
▒ বারুদ ২: “এসো কলম মেরামত করি”, আবু তাহের মিছবাহ, দারুল কলম
আমার কেন যেন মনে হয়, সাহিত্য বলতে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, ইসলামি সাহিত্য বলতে আমরা হয়তো বুঝি ইসলাম নিয়ে যেকোনো লেখালেখি। মানে বাংলা ভাষায় আমরা কিছু একটা লিখলাম, বা অনুবাদ করলাম, তাতে বাংলা ভাষার রূপবৈচিত্র, অলংকার, সৌন্দর্য থাকুক কি না থাকুক, যেহেতু বাংলায় ইসলাম নিয়ে কিছু একটা লেখা হয়েছে, কাজেই এটা ইসলামি সাহিত্য হয়ে গেছে। এই ধারণা যে কী পরিমাণ ভুল তা আবু তাহের মিছবাহর এ বইটি না পড়লে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমাদের অনেকেই ভাস্কর্য বা মাটির তৈরি তৈজসপত্র গড়তে বা বানাতে দেখে থাকবেন। সামনসামনি না হলেও টিভি-ইন্টারনেটের কল্যাণে দেখা হয়ে থাকার কথা। কী পরিমাণ অভিনিবেশ আর যত্নের সঙ্গে এক একজন মৃৎশিল্পী যে এসব ভাঙাগড়ার কাজ করেন, তা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়ার মতন। এখন সেই একই কাজ যদি কাউকে বাংলা ভাষায় লিখতে গিয়ে করতে দেখেন, কী মনে হবে তাকে? উন্মাদ? অতি খুঁতখুঁতে?
নাহ। তাহারেই আমি কইব ভাষাশিল্পী। আবু তাহের মিছবাহ আক্ষরিক অর্থেই একজন ভাষাশিল্পী।
কোন শব্দের সঙ্গে কোন শব্দ যায়, কোন শব্দ যায় না, কোন শব্দ কার শানে খাটে, কার শানে খাটে না, শব্দের ইতিবাচকতা, নেতিবাচকতা—নবিশ লেখক/অনুবাদকদের মনে যা কখনো উদয় হওয়ার দাবি রাখে না সাধারণত, এ অঙ্গনের বাইরের কারও কাছে যা মনে হতে পারে পাগলামি—সেসব বিষয় নিয়েই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন বর্ষীয়ান এই ‘আলিম!
জি, ঠিকই পড়েছেন। তিনি একজন ‘আলিম। এবং অতি উঁচুমানের ‘আলিম। একই সাথে ভাষাশিল্পী। ‘হুজুর’দের লেখালেখি শুনলেই যে এক শ্রেণির মানুষের হলদু দাঁতগুলো কেলিয়ে ওঠে, তাদের চোখ সত্যিকার অর্থেই তিনি কপালে ওঠানোর ক্ষমতা রাখেন। মাদরাসার উঠোনে তিনি ‘আদিব হুজুর’ বা ‘সাহিত্য গুরু’ নামে পরিচিত।
শুধু শব্দই নয়, একটা লেখার প্রতিটা বাক্য ধরে ধরে কীভাবে তার সুর-সংগতি বহাল রাখতে হয়, প্রয়োজনে কেটে-ছিড়ে নতুন করে সাজাতে হয় সেই ‘অপারেশন’ দেওয়া আছে উদাহরণসহ।
আমাদের লেখালেখির অঙ্গনে এক শ্রেণির লেখক/অনুবাদক আছেন ফরমায়েশি লেখক/অনুবাদক। শুধু কাজ পেলে লেখেন, না হলে কলম ছুঁয়েও দেখেন না। অথচ মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ রোজ নিয়ম করে দিনলিপি লেখার তাগিদ দিয়েছেন। সহজাত প্রতিভা না নিয়ে জন্মানো কেউ যদি নিজেকে সাহিত্যের মঞ্চে তুলে আনতে চান, তা হলে প্রতিদিন লেখার কোনো বিকল্প নেই। এমনসব ইত্যকার নানা কৌশলে পূর্ণ এই বইটি না পড়ে কারও লেখক/অনুবাদক হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনুচিত বলে মনে করি।
▒ বারুদ ৩: “সাহিত্যের ক্লাস”, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, মাকতাবাতুল আখতার
শেখার যে কোনো শেষ নেই, সেই প্রবচনের সার্থক উদাহরণ এ বইটি।
লেখালেখি বিষয়ক বই কুড়োচ্ছি সেই ২০১৩ সাল থেকে। বাংলা ভাষায় এ-সংক্রান্ত যত বই আছে, সম্ভবত তার বেশিরভাগই ২০১৭ সালের মধ্যে পড়া হয়ে গিয়েছিল আমার। লেখালেখির কৌশল নিয়ে মৌলিক বা অভিনব যা কিছু আমি অন্যান্য বইতে পেয়েছি, তা ঘুরেফিরে উপরের প্রথম দুটো বইয়ের কথারই ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন। কিন্তু এই ২০১৮ সালে এসে যাইনুল আবিদীনের এ বইটিতে সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস—অলংকার—একদমই নতুন করে জানলাম যেন। ঠিক জানলাম বললে ভুল হবে; আগেও জানতাম, কিন্তু জিনিসটা যে আসলে কী, কীভাবে এর প্রয়োগ—তা উনার আগে কারও লেখায় এত প্রখরভাবে দেখিয়ে দেয়নি কেউ। অথচ, সাহিত্যকর্মে অলংকার খুবই খুবই জরুরি জিনিস। এই অলংকারই একটি অসামান্য কর্মকে আলাদা করে গড়পড়তা কাজ থেকে। এই অলংকারের জোরেই কুরআন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। অথচ, সেই কুরআনের অনুসারীদের লেখনীতে তা সুন্দরবনের বাঘ দেখার মতো বিরল।
এ বইয়ের আরেকটি মূল্যবান আলোচনা: অনুবাদ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ অনুবাদকর্মই যে ‘বাংলা অক্ষরে লিখিত মাত্র’ সেই হাহাকার ফুটে উঠেছে যাইনুল আবিদীনের লেখায়। কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি সেই দৈন্য দশা কাটিয়ে উঠতে। যদি পারতাম, যারা প্রথমবারের মতো অনুবাদকর্ম শুরু করতে চান, তাদের কাজ শুরুর আগে আমি এ বইটা (এবং এর পরের বইটা) অবশ্যই পড়িয়ে নিতাম। এবং এ বইটা পড়ার আগে তার জন্য অনুবাদকর্মে হাত দেওয়াকে ‘হারাম’ ঘোষণা করতাম। আপনি যদি স্রেফ ফরমায়েশি অনুবাদক হোন, যদি শুধু দুটো টাকার জন্য অনুবাদকর্ম করেন তা হলে এ বই না পড়লেও চলবে। কিন্তু অনুবাদ যদি হয় আপনার শিরা-উপশিরা, তা হলে আমার মনে হয় এ বই ছাড়া আপনার অনুবাদ বাঁচবে না।
▒ বারুদ ৪: Literary Translation: A Practical Guide, Clifford E. Landers, Multilingual Matters
অনুবাদ করা নিয়ে কোনো বই যদি ‘পাঠ্যবই’ করতে হয়, তা হলে এটা সেরকম এক বই। এ বইটিও আমি খুব বেশিদিন আগে পড়িনি। তবে না পড়ে থাকলেও বইটির বেশিরভাগ নির্দেশনা আগে থেকেই অনুসরণ করতাম অনুবাদের বেলায়। শব্দে শব্দে অনুবাদ যে আসলে একটি কুসংস্কার, ওভাবে যে আদৌ অনুবাদকর্ম সুসম্পাদিত হয় না, যাইনুল আবিদীনের ভাষায় স্রেফ ‘বাংলা অক্ষরে লিখিত হয় মাত্র’, তার পক্ষে এ বইয়ের কথাগুলো আপ্তবাক্য।
বইটি আসলেই একটি প্র্যাকটিকাল গাইড। অনুবাদ করতে গিয়ে মনের ভেতর যত সংশয়, প্রশ্ন আসতে পারে তার কোনোটিই বাদ যায়নি। আগের বইয়ের বেলায় শেষের কথাগুলো এ বইয়ের বেলাতেও প্রযোজ্য।
▒ এখন জ্বলে উঠবেন কীভাবে?
শুধু খেলা দেখে কি খেলা রপ্ত করা যায়? না, যায় না। সেজন্য মাঠে নেমে খেলতে হয়। এ বইগুলো আপনাকে লেখালেখি-অনুবাদ সম্পর্কে অভিনব সব চিন্তা আর কৌশলের কথা শেখাবে। কিন্তু তা মকশো না করলে, নিয়মিত না লিখলে, অনুবাদ না করলে তা দক্ষতা হিসেবে শেকড় হয়ে মজবুত হবে না। আপনার প্রতিটি লেখা ছাপার হরফে আসতে হবে তার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিটি লেখা ফেইসবুক বা অনলাইনে আসতে হবে তারও কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের মনের আনন্দে, নিজের লেখার উন্নতির জন্য, অনুবাদের ভাষার মাধুর্য বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে কাজ করুন। ছ মাস আগে যেভাবে লিখতেন, আজও যদি সেখানেই পড়ে থাকেন, তা হলে বুঝে নেবেন আপনার কোনো উন্নতি হয়নি। মন থেকে যদি উন্নতির টান না পান, যদি শুধু অর্থের কারণে লিখে যান, তা হলে একাজটি হয়তো আপনার জন্য নয়। যদি একদিন কিছু না লিখলে মন আনচান করে, যদি প্রতিদিন একই শব্দের পুনরাবৃত্তি আপনার মনকে বেচান করে, তা হলে বুঝবেন আপনার মাঝে শলাকা আছে। উপরে দেওয়া বারুদে ঘষে এখন শুধু জ্বলে ওঠার অপেক্ষা...
পুনশ্চ: লেখালেখিটাকে কি হঠাৎ করে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে? সত্যি কথা বলতে, সৃজনশীল কোনো কাজই সহজ নয়। ভাতের মাড় গালা দেখতে যত সহজই মনে হোক, নিজে করতে গেলে বুঝবেন কত ধানে কত চাল। সেকালের রবীন্দ্রনাথ কিংবা একালের হুমায়ূন—কেউই হাসতে-খেলতে লেখক হয়ে যাননি। কিংবা অনুবাদ সাহিত্যে একজন অনীশ দাস অপু বা কবীর চৌধুরী বা শওকত হাসানেরা স্রেফ ইংরেজিটা ভালো জানার কারণে খ্যাতনামা অনুবাদক হয়ে যাননি। এদের প্রত্যেকের জীবনটাকে খতিয়ে দেখুন: অনেক অনেক অধ্যবসায় (শব্দটা যতই আপনাকে স্কুলের রচনার কথা মনে করিয়ে দিক, বাস্তব দুনিয়ায় এর বিকল্প নাই), চর্চা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাধা ডিঙিয়ে একেকজন জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। দীনের চেতনায়, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমাদের মধ্যে যদি অনুরূপ আত্ম-নিবেদন, পরিশ্রম আর জানাশেখার মানসিকতা না থাকে, তা হলে সাহিত্যের সবকিছু দুষ্টদের দখলে চলে গেল—এমন আক্ষেপ কেবল ভার্চুয়াল মনস্তাপ আর অন্যের সমালোচনা ছাড়া ভালো কিছু দেবে না।
মাসুদ শরীফ
উপ-সম্পাদক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
No comments:
Post a Comment