Saturday, February 24, 2018

গণিতের নামে আমরা একঘেয়ে হিসাব করা শিখাই

ভাষার মাসে একটা অন্যরকম ভাষা নিয়ে কথা বলি। লম্বা লেখা, তবে আশা করি নতুন কিছু চিন্তার খোরাক জুটবে। স্টিফেন উলফ্রামের (Stephen Wolfram) সাথে গত মাসে এমআইটিতে একটি টকে কথা বলার সুযোগ হয়। বিশিষ্ট গণিতবিদ ও পদার্থবিদ। ম্যাথমেটিকা সফটওয়্যারের প্রধান আর্কিটেক্ট উনি। এআই নিয়ে তাঁর চমৎকার আইডিয়াগুলো আরেকদিন লিখব। তবে এই এআইয়ের যুগে পড়াশোনার কারিকুলাম ও আমরা কিভাবে গণিত করি এবং শিখি, তা নিয়ে উনার কিছু কথা আমার ব্যক্তিগত চিন্তার সাথে খুব মিলেছে। সেটা হচ্ছেঃ গণিতের নামে আমরা একঘেয়ে হিসাব করা শিখাই। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে যেভাবে ২ + ২ = ৪ শেখানো হয়, তা কিন্তু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বা গ্র্যাজুয়েট লেভেলেও পরিবর্তন হয় না অনেক সময়। কিন্তু গণিত কি আসলে এটাই? কিভাবে এর কারিকুলাম পরিবর্তন করা উচিত?

গণিত একটি ভাষা। মানবজাতির সৃষ্ট ভাষার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে কৃত্রিম কিন্তু এলিগ্যান্ট। এর বদৌলতে আমরা যেকোন ঘটনাকে বর্ণনা করতে পারি একজন আরেকজনের কাছে। আবার সব ভাষার মতই এক বাক্যের বর্ণনাকে কাটাকুটি করে সেই বাক্যকে সরলীকরণ করতে পারি। দুঃখর কথা হচ্ছে যে এই ব্যাপারটা ছাত্রদের পরিষ্কার করে বলা হয় না। GRE পড়লে ভোকাবুলারি বাড়ে, সেরকমভাবে নানা টেকনিক্যাল বিষয় পড়লে গণিত দিয়ে একটি ধারণাকে বর্ণনা করার ক্ষমতা বাড়বে। হ্যামিল্টনিয়ান বা লাগ্রাঞ্জিয়ান দিয়ে যা বর্ণনা করতে পারি, তাকে ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনে নিয়ে আসতে পারি, কিংবা সহজ ভাষায় লিখতে পারি F = ma. এই তিন প্যারাডাইমেই শব্দগুচ্ছকে ম্যানিপুলেট করার লজিক আলাদা, কিন্তু একই জিনিস বর্ণনা করা যায়। যত নতুন তথ্য দিতে চাবো, ততই বাক্যের পরিধি বাড়বে। সাধারণ ভাষার মতই। আবার সাধারণ ভাষা এবং গণিতের ভাষা একত্র করে না লিখলে আমরা সাধারণত বুঝতেই পারি না কি বলা হচ্ছে।

আমাদের বর্তমান কারিকুলামে ছাত্রছাত্রীদেরকে রোবট হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদেরকে অনেক হিসাবের উদাহরণ দেয়া হয়, যেমন ২ + 2 = ৪ ইত্যাদি busy work। এআই যেরকম অনেক উদাহরন থেকে বোঝার চেষ্টা করে what the hell is going on, আমরাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এখন তাই করি। উদাহরন শেখা ভালো কিন্তু কি কারনে উদাহরন শিখছি সেটাই অনেক সময় পরিষ্কার না, আবার একই ধরণের উদাহরন বারবার করালে একঘেয়েমি বাড়ে, কিন্তু তাইই বর্তমানে করানো হয়। ব্যাপারটা তখন আর কনসেপ্ট বেসড থাকে না, মুখস্ত বিদ্যার মত হয়ে যায়। বড় নামতার টেবিল মুখস্ত না করে আমরা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করি। কিন্তু, নানা অপারেটর অ্যালজেব্রা দিয়েই গণিত বা পদার্থবিদ্যা/ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক কোর্স চলে যায়। সেটা ২ + ২ = ৪ শেখার থেকে বেশি কিছু না। কিন্তু এই যুগে কম্পিউটার এসব খুব সুন্দরভাবে করতে পারে।

এরপরের স্টেপ হচ্ছে গণিতের ভাষার পাশাপাশি মানুষের ভাষায় গণিত করার জন্য কম্পিউটারকে তৈরি করা। wolframalpha এরকমই একটি সফটওয়্যার। স্টিফেনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা মানুষের ভাষায় বলব এভাবেঃ "এই সার্ফেসের উপর সব চার্জকে যোগ করলে কত হয়?" আর কম্পিউটার একঘেয়ে হিসেবগুলো করে আমাদের জবাব দেবে। Div, Grad, Curl নিয়ে আমাদের প্রতি নিয়ত মাথা ঘামানোর দরকার নেই, এবং উচিৎ ও না। স্টিফেন তার নিজের হাই স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে পাতার পর পাতা ক্যালকুলাসের অ্যালজেব্রার পিছে সময় নষ্ট করতে মানা করেছে। অর্থাৎ, আমাদের হাই স্কুল বা কলেজ গণিত সিলেবাস অনেকটুকুই সেই অর্থে বোগাস। wolframalpha নিয়ে স্কুল টিচাররা অনেক অভিযোগ পাঠায়, ছাত্ররা এটা ব্যবহার করে নাকি সব উত্তর বের করে ফেলে। তাতে আমাদের মত গোষ্ঠীর মানুষের তেমন একটা গা নেই, একটি কম্পিউটার যেই কাজ করতে পারে সেই একই কাজ কি মানুষের সারা জীবন ধরে শেখার দরকার আছে?

বেশিরভাগ কারিকুলাম এরকম mechanistic হিসাবে ভরা, অর্থাৎ আমরা একটা ছাত্রের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করছি। অথচ, আমাদের ভবিষ্যৎ ফ্রন্টিয়ার হওয়া উচিৎ এরকমঃ মানুষ আগে কনসেপ্ট বুঝে সমস্যা ব্রেকডাউন করবে, তারপর কম্পিউটারকে নিজের ভাষায় তা জিজ্ঞেস করবে ("সব চার্জ যোগ করে কত হয়?"), কম্পিউটারের তৈরি করা রেজাল্ট বুঝতে শিখবে, তারপর কিছু বিগড়ে গেছে নাকি তা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় একঘেয়ে mechanisitc জ্ঞান যা দরকার তা শিখবে। সারা বিশ্বের গণিত শিক্ষা এখন এর পুরো উল্টোভাবে চলছে। অর্থাৎ, আমাদেরকে কম্পিউটার সারানোর mechanistic বিদ্যা (মানে হিসাবে গণ্ডগোল ধরতে পারা) শেখানো হচ্ছে জীবনের প্রায় দুই দশক ধরে, কিন্তু এই যন্ত্র ব্যবহার করে কিরকম মজার কাজ করানো যায় সেটাই শেখানো হচ্ছে না। সেটা আসা উচিৎ শুরুতে। নাহলে গণিত হয়ে যায় পীড়াদায়ক একটা ব্যাপার, যেটা শুধু নিয়ম মেনে চলা মানুষরা কষ্ট করে শিখে নেয়। অনেকের কাছেই এটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার হিসেবে রয়ে যায় সারা জীবন। এমনকি পিএইচডি নিয়ে বের হলেও আমরা অনেকে ধরতে পারি না গণিত আসলে কি, এবং কত সুন্দরভাবে একে ব্যবহার করা যায়।

প্রোগ্রামিং শেখার জন্য এখন এরকম টুল আছে, যেমন Scratch। সেটা দিয়ে শুরুতে “হেলো ওয়ার্ল্ড” না লিখে বাচ্চারা এখন সুন্দর সব গল্প তৈরি করতে পারে। গণিতের জন্য Scratch কি তৈরি করা যায়? যেখানে গাণিতিক মডেল দিয়ে গল্প তৈরি করা যাবে। সেটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার হবে।

(btw, এখনকার প্রোগ্রামাররা কম্পিউটারের কাছে একটি লজিক বোঝানোর জন্য জটিল ভাষায় কোড লিখে বড়াই করে, কিন্তু সেদিন খুব দূরে না যখন অনেক প্রোগ্রামারের কাজ স্বয়ংক্রিয় ভাবে করা যাবে। যেই কাজ এআই করতে পারে, তা কিন্তু খুব বুদ্ধিমত্তার কিছু না। মানুষ হিসেবে আমাদেরকে সৃজনশীল হওয়া শেখানো উচিৎ, রোবট হওয়া না।)

লেখাটা শেষ করি এলিয়েনদের জন্য নতুন ভাষা কিভাবে তৈরি করা উচিৎ, তা নিয়ে Arrival নামক ছবিতে স্টিফেনের ছেলের করা একটি কাজ শেয়ার করে। ছেলেমেয়েদের এরকম মজার, সৃজনশীল গণিত সমস্যা দেয়া উচিৎ আগে, নানারকম ফাংশন ব্লকের ভেতরে কি চলছে সেটা শেখা উচিৎ পরে।

* Nazmus Saquib

http://blog.stephenwolfram.com/2016/11/quick-how-might-the-alien-spacecraft-work/

No comments:

Post a Comment